নিদ্রার ঘনঘন ব্যাঘাত ঘটানো ও হৃদযন্ত্রসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ক্ষতির সম্মুখীন করা অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (OSA) একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। এই রোগে রোগীর শ্বাসনালী শীতে শীতে আটকে যায়, যা শেষ পর্যন্ত অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, ঘুমকে অপ্রসন্ন করে এবং দিনের মাঝেও মনোযোগের দীর্ঘ প্রতীক্ষা তথা ক্লান্তি তৈরি করে।
OSA-এর প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত দিনে ঘুম এবং গভীর অনিয়ন্ত্রিত শ্বাস বন্ধ। ঘুমের সময় হঠাৎভাবে জেগে ওঠা, গলার শুকনো ভাব, সারাদিন ক্লান্ত লাগা, মাথাব্যথা, ঘুমোচ্ছিন্নতা, ঘুমানোর সময় অতিরিক্ত প্রস্রাব করা, মনোযোগ হারিয়ে ফেলা – এসবই ইঙ্গিত দেয় যে OSA আপনার স্বাভাবিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
OSA-এর সঠিক নির্ণয়ে চিকিৎসক সাধারণত একটি পূর্ণাঙ্গ স্লিপ স্টাডি বা পলিসমনোগ্রাফি (PSG) পরামর্শ দেন। এটি একটি রাতব্যাপী পরীক্ষা, যা আপনার ঘুমের বিভিন্ন পর্ব, শ্বাসপ্রশ্বাসের গড়, অক্সিজেনের স্তর, হৃদস্পন্দন এবং পেশীর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। এ ছাড়া মাঝে মাঝে হোম স্লিপ টেস্ট (HST) ব্যবহৃত হয়; এটি বাড়িতে করা যায় এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা হলেও PSG’র তুলনায় সম্পূর্ণ তথ্য দেয় না।
পরবর্তী ধাপে চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর অবস্থা এবং OSA-এর তীব্রতার উপর। প্রথম সারির চিকিৎসা হলো CPAP (Continuous Positive Airway Pressure) যন্ত্র: একটি ছোট, শান্ত, সাশ্রয়ী যন্ত্র যা রাতে শ্বাসনালীর পৃষ্ঠে চাপ প্রয়োগ করে শ্বাসনালীর ধস হওয়া বন্ধ করে দেয়। রোগীরা দিনের পর দিন CPAP ব্যবহার করলে ভালো ঘুম, অধিক মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং সঙ্গীরও আরও শান্ত ঘুমের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। যদিও প্রথমে কিছু সমস্যা যেমন শুষ্কতা, মাস্ক ফাঁস, CPAP-এ অভ্যস্ত হতে সমস্যা বা অতিরিক্ত চাপ বোধ হতে পারে—তবে এই সমস্যাগুলো নিরীক্ষণ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।
যদি কেউ CPAP সহ্য করতে না পারেন, তাহলে বিকল্প হিসেবে ওরাল অ্যাপ্লায়েন্স বা ডেন্টাল স্প্লিন্ট (Mandibular Advancement Splints) ব্যবহৃত হতে পারে। এটি একটি সহজ কাঠের বা প্লাস্টিকের মতো সজ্জিত ডিভাইস, যা ঘুমের সময় নীচের চোয়াল সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে শ্বাসনালী মুক্ত রাখে। এটি OSA-এর হালকা থেকে মাঝারি স্তরে কার্যকর হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, এটি CPAP-এর সাথে মিলিয়ে ব্যবহার করেও OSA-এর চিকিৎসা করা যায়। প্রাথমিক সময়ে কিছু অস্বস্তি, থুতু ঝরা, দাঁত বা চোয়ালে ব্যথা, বা দাঁতের সাময়িক অবস্থান পরিবর্তন ইত্যাদি হতে পারে; তবে সময়ের সঙ্গে এগুলো দূর হয়।
যদি ওরাল ডিভাইস বা CPAP কাজ না করে, তবে শল্যচিকিৎসার (সার্জারি) দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। শল্যপদ্ধতি নির্ণয়ের আগে সাধারণত বিশদ শল্য পূর্ব মূল্যায়ন করা হয়—যেমন ঘুমের পরীক্ষা, শারীরিক পরীক্ষা, ফাইব্রো-অপটিক পরীক্ষা, স্লিপ এন্ডোস্কোপি, সিটি বা এমআরআই স্ক্যান ইত্যাদি। এর ভিত্তিতে উপযুক্ত শল্য পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়।
শল্যপদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
নাকের অস্ত্রোপচার—যেখানে টার্বিনেট, নাকের বিভাজক সোজা করা বা অ্যাডেনয়েড সরানো হয়, বিশেষ করে যখন নাকের অবরোধ CPAP ব্যবহারে বিঘ্ন ঘটায়।
প্যালেটাল সার্জারি—মক্কালপলেট বা ইউভুলার পলিপে থাকা ফ্লপি টিস্যু কমিয়ে শ্বাসনালী প্রশস্ত করা হয়।
জিহ্বর বা হাইপোফ্যারিঞ্জিয়াল অঞ্চল সম্বন্ধীয় অস্ত্রোপচার—যেখানে জিহ্বর ও লিংগুল টনসিল বা টিস্যু কমানো হয় বা বোনি সার্জারি যেমন জেনিওগ্লসাস অ্যাডভান্সমেন্ট, হায়য়য়েড সাসপেনশন ইত্যাদি করা হয়।
ম্যাক্সিলোম্যান্ডিবুলার অ্যাডভান্সমেন্ট একটি গভীর কিন্তু কার্যকর অপারেশন, যেখানে উপরের ও নীচের জবাল সামনের দিকে এগিয়ে এনে শ্বাসনালি প্রশস্ত করা হয়—এর সাফল্যের হার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
সর্বশেষে, হাইপোগ্লোসাল নার্ভ স্টিমুলেশন—এ একটি ইমপ্লান্টেবল ডিভাইস দিয়ে ঘুমের সময় জিহ্বরের মাসলকে সংবেদনশীল করে রাখা হয়, যাতে শ্বাসনালী খোলা থাকে।
সর্বাধিক চরম সময়ে, ট্রাকিওস্টমি করা হতে পারে—যেখানে গলার নিচে একটি ছোট গর্ত তৈরি করে শ্বাসনালী সরাসরি খুলে দেওয়া হয়। যদিও খুব কার্যকর, রোগীরা সাধারণত এটি গ্রহণ করতে মনোযোগী হন না, কারণ এটি গলার নিচে একটি চিহ্ন ফেলে এবং স্টিগমা তৈরি করে।
OSA-এর চিকিৎসায় জীবনযাত্রার পরিবর্তনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন–পাশের দিকে ঘুমানো, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার, প্রয়োজন না হলে সিডেটিভ ঔষধ বা ঘুমোলার ট্যাবলেট এড়িয়ে চলা, এবং মাইয়োফাংশনাল ও নাসাল শ্বাস ব্যায়াম করা।
এসব চিকিৎসা ও উদ্যোগের মাধ্যমে আপনি OSA থেকে মুক্তি sleep apnea পেতে পারেন, ঘুমের মান উন্নীত করতে পারেন এবং দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, ডিপ্রেশন, দুর্ঘটনার ঝুঁকি—সবই কমিয়ে আনতে পারেন। সক্রিয়ভাবে চিকিৎসা গ্রহণ ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে আপনি একটি স্বাস্থ্যকর ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ফিরে পেতে পারেন।